নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ হয় মৃত্যুর মিছিল। কিন্তু পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ হয় না। গত ১৩ বছরে পাহাড়ধসে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর পরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ এখানে বসবাস করছেন।
পাহাড়ে বসবাস করা বেশির ভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের। সেখানে বসবাসের জন্য নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপর কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। সময় যত গড়ায়, তৎপরতাও থিতিয়ে যায়।
টেকনাফ উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ৩২টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৩৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১টি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪টি।
২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত টেকনাফে পাহাড়ধসে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান ২০২০ সালে।
যেসব পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস
টানা বর্ষণে ভূমিধসের আশঙ্কায় উপজেলায় হ্নীলা, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং ও টেকনাফ পৌরসভার ৩২ পাহাড়ি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকায় প্রায় সাত হাজার পরিবারের অর্ধলাখের কাছাকাছি মানুষ বসবাস করে আসছেন। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হলো ফকিরামুড়া, বৈদ্যের ঘোনা, কুয়েত মসজিদ, পুরান পল্লানপাড়া, নাইট্যংপাড়া, বরইতলী, ঘুমতলী (বিজিবি ক্যাম্পের পেছনে), মরিচ্যগুনা, পশ্চিম সিকদার পাড়া, মুরাপাড়া, লেচুয়াপ্রাং, ভিলেজারপাড়া, পশ্চিম রঙ্গীখালী, গাজীপাড়া, আলীখালী, লম্বাবিল, করাচিপাড়া, আমতলী, হাতিয়ার গোনা, হাবিরছড়া, কেরুনতী, মহেশখালী পাড়া, শিয়াইল্যামুরা, সাতঘরিয়াপাড়া, হাছইন্নাটেক, শামলাপুর পুরানপাড়া, বড় ডেইল, মাথাভাঙ্গা জাহাজপুরা, মারিষবুনিয়া ও বাইন্যাপাড়া।
স্থানীয় একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘একজনকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে কেরুনতলী এলাকার পাহাড়ে বসবাস শুরু করি। প্রশাসন একবার উচ্ছেদও করে। পরে আবার এখানে ঘর তৈরি করে থাকা শুরু করি। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তাই বাধ্য হয়ে এখানে থাকতে হচ্ছে। সরকার যদি আমাদের পুনর্বাসন করে তাহলে সেখানে চলে যাব।’
অভিযোগ আছে, দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করলেও প্রশাসনের এ বিষয়ে তেমন নজর নেই। বিশেষ করে কেরুনতলী এলাকায় পাহাড় কেটে স্থাপনা তৈরি করে বসবাস করছেন বহু মানুষ। সেখানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী নাছিমা খাতুন বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে এখানে বসবাস করছি। আমাদের এখানে কোনো পাহাড়ধসের ঘটনা নেই। স্বল্প বেতনে চাকরি করি। এখানে বাসা ভাড়া কম, তাই থাকি।’
জোছনা বেগম নামে আরেকজন বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই ভয়ে থাকি। যাওয়ার জায়গা নেই। কেউ পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করে না। এ কারণে এখানে থাকা। পরিমল নামের একজন পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে থাকেন আলীখালী পাহাড়ের ঢালে। তিনি বলেন, মাসে যা আয় করি, এখানে থাকা ছাড়া তো উপায় নেই। ধস হলে বিপদ হবে জেনেও এখানে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। সরকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে চলে যাব।’
অন্যদিকে প্রশাসন বলছে, পাহাড় কারও ব্যক্তিমালিকানাধীন হতে পারে না। যারা দখল করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর জনগণের জানমাল রক্ষার্থে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা লোকজনকে সরিয়ে ফেলা হবে। প্রয়োজনে জোরপূর্বক সরানো হবে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহীন ইমরান জানান, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে পাহাড়ধসের আশঙ্কা রয়েছে। তাই কেউ যাতে মানবিক বিপর্যয় ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির শিকার না হয়, সেই লক্ষ্যে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার জন্য মাইকিং অব্যাহত রয়েছে। লোকজনকে অনুরোধ করা হচ্ছে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে। পরিস্থিতি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হলে প্রশাসন দিয়ে লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হবে। প্রয়োজনে উচ্ছেদ করা হবে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা বসতি।
পাহাড়ের পাদদেশে বা পাহাড়ের চূড়ায় অতিঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা পরিবারের জন্য একটি স্থানে অবকাঠামো তৈরি করে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে জীবন-জীবিকার একটি প্রস্তাবনা দাখিল করা হয়েছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক। আর এসব পাহাড়ে বনায়ন করে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণদের বিপর্যয় ও সম্পদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে বলে মনে করছে সচেতন মহল।