‘অর্থই অনর্থের মূল’
- আপডেট সময় : ০৭:২৮:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৩ ৫৭ বার পড়া হয়েছে
ডলার সংকট, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে তো বাড়ছেই, দ্রব্যমূল্য ঘোড়া লাগাম ছিঁড়ে লাফ দিয়ে দিয়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে, আই এম এফ ঘাড়ে ধরে বলছে, ওহে তোমার পরিসংখ্যানের পরী উড়ে গিয়ে যে সংখ্যা পড়ে আছে; তাতে রিজার্ভের অবস্থা কিন্তু তথৈবচ। হলিউড ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানালে রাখাল বালক তারকা হয়ে বাঁশী বাজাচ্ছেন, লোকে বলে বলেরে ঘর বাড়ি ভালা না আমার।
মার্চেন্ট অফ কাঢা(!) শাইলকেরা ব্যাংকগুলো খেয়ে দিলে; ঋণ দেয়া যাবে না বলে নোটিশ ঝুলিয়েছে ব্যাংক। জাদুকরেরা “টাকা বাড়িয়ে দেবার” স্বপ্ন দেখিয়ে; প্রজাদের টাকা হাপিস করে দিয়ে; ওমরাহ করতে মক্কায় ছুটছে। জাদুকর পিকে টাকা ভ্যানিশ করে বারানসীতে তীর্থ করতে গেলে শ্বশুর বাড়ির শ্যালকেরা তাকে গিয়ে বলেছে, এমন ঔদাসীন্য ভালো নয়, চলুন জামাইবাবু শ্বশুর বাড়িতে থাকবেন।
প্রজাদের হাতে টাকা নেই, স্কুল শিক্ষকের পকেট ঠন ঠন করছে। তবু স্কুল কমিটি তাকে নোটিশ দিয়েছে, তিরিশ কর্মদিবসের মধ্যে বিবাহ করা চাই। সতীদাহ প্রথা নেই তো কী হয়েছে; এখন শুরু হলো, সতদাহ প্রথা।
ঋষি-দরবেশরা শেয়ার বাজারে জালালুদ্দীন রুমীর হুইরলিং ডারবিশ হয়ে হাত দুটো উপরে তুলে নৃত্য করছে, পরের জায়গা, পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই, আমি তো ভাই ঘরের মালিক নই।
টেকাটুকা নিয়ে সক্রিয় মানুষ অর্থমন্ত্রী হঠাত ঋষি হয়ে গেছেন। তিনি ঘরের জানালার পাশে রবি ঠাকুরের ডাকঘর নাটকের অসুস্থ অমলের মতো বসে থাকেন। বাইরে ব্যাংকওয়ালার ডাক, ব্যাংক নেবে ব্যাংক, পাঁচমুড়া পাহাড়ের ওপারে শ্যামলী নদীর ধারে মামু-ভাগ্নের ফার্মার্স ব্যাংক!
অমল জানালা বন্ধ করে দেয়, আজকাল দইওয়ালাও ব্যাংকওয়ালা হয়ে গেছে। নাহ আমায় আর সুস্থ হতে দেবে না এরা!
অর্থমন্ত্রণালয়ের কেবল ক্রয় সংক্রান্ত বৈঠকে মাঝে মাঝে যোগ দেন তিনি। রিটার্নিং অফিসারদের ক্রয়ের নেশা; ওদের বড় বড় গাড়ি কিনে না দিলে যদি গণতন্ত্রের স্তম্ভ ধরে নড়িয়ে দেয়; তাই অগত্যা গৌরি সেনের টাকায় তাদের আবদার পূরণ করতে হয়।
কেউ কেউ অভিযোগ করে, আপনি তো ডুমুরের ফুল হয়ে গেলেন স্যার!
কী করবো বাইরে এডিস মশারা ঘুরছে; ডেঙ্গি এসে জ্বর দিয়ে গেলে যদি টেঁসে যাই, তাহলে বিপিএল ক্রিকেট ম্যাচ দেখবো কেমন করে। আদরের মেয়েটির তো ঐ একটিই শখ।
লোকে মৃদু অনুযোগ করে, আপনার সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন, আপনি আমাদের ক্যাশাবাবু, কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ আপনার সঙ্গে!
মনের মানুষরে পাইতে অনেক মারফতী তরিকা আছে। যাও সাধনা করো, নিশ্চয়ই তাকে পাবে!
বাধ্য হয়ে অর্থ সচিবের দ্বারস্থ হয় প্রজারা। কিন্তু তিনি কম কথা বলেন। শান্ত নিমীলিত চোখ চশমা দিয়ে ঢাকা।
তার পিএস বলেন, সিভিল সার্ভিসের ট্রেনিং হচ্ছে কথা কম বলা। “ও মানুষ তোমার তোমার দুইটা চোখ দেখপা, দুইটা কান শুনপা, কিন্তু একটা মুখ তো, একটু কথা কম কপা!
উগান্ডা(!) ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে একটু ভালো অবস্থায় থাকা ব্যাংকগুলোর এমডিরা দেখা করতে গেলে, তিনি বসতে বলেন না; দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলেন, শিক্ষক কখনো ভালোছাত্র নিয়ে চিন্তা করেনা। চিন্তা তার খারাপ ছাত্র নিয়ে। দেশে দেউলিয়া হবার পথে খারাপ ব্যাংকের সংখ্যাই বেশি, তাই তাদের প্রাইভেট টিউশন দিই। যান আপনারা অফিসে গিয়ে চেয়ারে বসেন, এইখানে চেয়ার নাই।
সাবেক গভর্ণর রাখাল রাজাকে হলিউড ফিল্ম বানিয়েছে, এই গভর্ণর চাননা হলিউডের নায়ক হতে। তাই তিনি দিনমান ব্যাংকের ভল্ট পাহারা দেন।
তবু হেক্সা কোম্পানি ২২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায়। বড় আদরের ছোট ভাই; তাকে তো নিষেধ করা যায়না। সে তো চেতনার নৌকার ছোট মাঝি নয়, সে জাহাজের সারেং।
আর ঋণ খেলাপিদের আরো ঋণ নেবার তকদীর ও তদবিরের আইনি রক্ষা কবচের তসবিহ টিপতে থাকেন তিনি অবসরে।
নোবেল বিজয়ী ড্যাশের বকেয়া ট্যাক্সের টাকাগুলো জমা দিয়ে দেবার পর কাজে মন নেই রাজস্ব বোর্ডের প্রধানেরও। তাকেই টুস করে পদ্মা ব্রিজ থেকে ফেলে দেয়া গেলোনা ট্যাক্সের রুমালের ফাঁস পরিয়ে; এখন আর কী হবে ট্যাক্স ট্যাক্স খেলে। তারচেয়ে বরং মন দিয়ে পড়া যাক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস, কালো রাজস্ব হলুদ হিমু।
একজন ব্যবসায়ী আক্ষেপ করেন, কত জরুরি কাজ আছে রাজস্ব প্রধানের সঙ্গে, কিন্তু উনি আসি আসি করে যেন আর এলেন না।
অর্থ সচিব, গভর্ণর, রাজস্ব বিভাগের প্রধান “ভিসা নেই ভিসা নেই ছোট সে সোনার তরী, আমারই সোনার পাপে গিয়াছে ভরি” বাক্যাংশের ভাবসম্প্রসারণ জানতে অর্থমন্ত্রী কাছে যান, অসুস্থ অমলের জন্য আপেল বেদানা ও কমলা নিয়ে।
অর্থমন্ত্রীর পুরো বাড়ির ওপরে একটি বৃহত মশারী। আগত অতিথিদের পকেটে ও ভ্যানিটি ব্যাগে মশা আছে কীনা তা চেক করে ভেতরে নিয়ে যা্ন, বাড়ির চিফ মশা হিট অফিসার। অর্থ বিভাগের ত্রিমূর্তিকে নৈরাশ্য বিমূঢ় ঝুলে যাওয়া মুখমণ্ডল নিয়ে আসতে দেখে অর্থমন্ত্রী বলেন,
চুপ চুপ চুপ
অনামিকা চুপ
কথা বলোনা
তুমি আমি এখানে
তা কেউ জানে না।’
লেখক: মাসকাওয়াথ আহসান এডিটর ইন চীফ ই-সাউথ এশিয়া