কবিতা উন্মুক্ত চেতনার চিরন্তন বানী
- আপডেট সময় : ০৯:০৪:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২০৮ বার পড়া হয়েছে
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দু’দিন ব্যাপী স্থানীয় কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে সাহিত্যে সম্মেলন আয়োজন করায় আন্তরিক ভাবে আনন্দে আপ্লূত হয়েছি। সাহিত্য সম্মেলনকে কেন্দ্র করেই কবি ও কবিতা কি এই সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো।
সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হলো কবিতা। কবিতাকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, প্রথমত মহাকাব্য, দ্বিতীয়ত গীতিকাব্য। পৃথিবীতে যখন কোন অক্ষরজ্ঞান ছিল না, তখনো মানুষের মুখে কবিতা ছিল। এখনো কবিতা নিয়ে মানুষের আগ্রহের কোন কমতি নেই। প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে কবি সত্তা জড়িয়ে আছে। মানুষের মনের মাঝে ভাব, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ ও অনুভূতিগুলো ছন্দোবদ্ধ আকারে প্রকাশ করাকেই কবিতা বুঝায়। আজ পর্যন্ত কোনো কবি কবিতার সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা দিতে পারেননি। কবিতা নিয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত কবিগণ কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নিজ নিজ ভাবনা প্রকাশ করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত কবিদের ভাবনা থেকেই আমরা কবিতা কি এটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।
বিশ্বখ্যাত কবিদের কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে কিছু ভাবনাঃ গ্রিক কবি ও দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়।’ এখানে তিনি কবিতার মাধ্যমে মানুষের সুগভীর ভাবনার প্রকাশ ও এর বিশালতার উল্লেখ করেছেন। কবিতা নিয়ে তাঁর ভাবনার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি, কিন্তু এটি কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচিত হয়নি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম কবি পার্সি বিশি শেলি কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘কবিতা পরিতৃপ্তির বিষয়। কবিতা তখনই সার্থক হয়, যখন কবি মনের পরিতৃপ্তিতে পূর্ণতা আসে।’ তাঁর ভাষায় বোঝানো হচ্ছে, কবিতা হলো মানুষের পরিতৃপ্তির বিষয়। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ হচ্ছে কবিতা। তবে এটিও কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে পরিপূর্ণতা পায়নি।
ইংরেজি সাহিত্যের কবি জন কীটস বলেছেন, ‘কবিতা মুগ্ধ করবে তার সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায়, একটি মাত্র ঝংকারে নয়। পাঠকের মনে হবে এ যেন তারই সর্বোত্তম চিন্তা, যা ক্রমশ ভেসে উঠছে তার স্মৃতিতে। জন কীটস বোঝাতে চেয়েছেন, শুধু ছন্দে ও অন্ত্যমিলে কোনো কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হবে না। কবিতা পাঠকের হৃদয়ে দাগ কাটবে এবং নিজের ভাবনাগুলো কবিতায় খুঁজে পাবে। কবিতা নিয়ে কীটসের এই বক্তব্য অর্থবহ হলেও সংজ্ঞাটি কিছুটা বিতর্কিত।
কবি মেকল বলেছেন, ‘কবিতা বললে আমরা বুঝি সেই শিল্প, যা শব্দকে ব্যবহার করে এমনভাবে, যা কল্পনার রাজ্যে জাগিয়ে দেয় এক স্বপ্ন।’ কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, ‘কবিতা হলো ‘পারফরমেন্স ইন ওয়ার্ডস’। কবি কোলরিজ বলেছেন, ‘গদ্য মানে শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো। আর পদ্য মানে সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো।’
কবি এডগার এলান বলেছেন, ‘কবিতা হলো সৌন্দর্যের ছন্দময় সৃষ্টি।’ কবি এলিয়ট বলেছেন, ‘কবিতা রচনা হলো রক্তকে কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রণা।’ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, ‘কবিতা সব জ্ঞানের শ্বাস-প্রশ্বাস আর সূক্ষ্ম আত্মা।’ কবি কার্লাইল বলেছেন, ‘কবিতা হলো মিউজিক্যাল থট।’ কবিতা নিয়ে এই বিখ্যাত কবিদের ভাবনা খুব সুন্দর ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। তবে কারও বক্তব্য কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।
কবি সেন্ট অগাস্টিন কবিতা সম্পর্কে তাঁর ভাবনা থেকে বলেছেন, ‘যদি জিজ্ঞাসা করা না হয়, আমি জানি। যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি জানি না।’ এখানে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, কবিতা কি, সেটা আমরা জানি। যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন কবিতার সংজ্ঞা দেওয়া মুশকিল। মনে হবে, কবিতা একটা রহস্যময়, অজানা কিছু, যা আমরা জানি না।
কবি জনসন বলেছেন, ‘কবিতা হলো মেট্রিক্যাল কম্পোজিশন। আনন্দ ও সত্যকে মেলানোর শিল্প, যেখানে রিজনকে সাহায্য করার জন্যে ইমাজিনেশনের ডাক পড়ে।’ এখানে তাঁর বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কবিতা হচ্ছে এমন একটি শিল্প, যা দিয়ে আনন্দের সঙ্গে সত্যকে প্রকাশ করা হয়। আর সেটা প্রকাশ করার জন্য কল্পনার প্রয়োজন হয়। কবিতা বিষয়ক এই দুটি বক্তব্য থেকে কবিতার গভীরতা ও বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, তবে এটিও কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে স্পষ্ট নয়।
আমাদের বিখ্যাত বাঙালি কবিগণও কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নিজেদের ধারণা প্রকাশ করেছেন। কবি হুমায়ুন আজাদের মতে, ‘যা পুরোপুরি বুঝে উঠব না, বুকে ওষ্ঠে হৃৎপিণ্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাব না, যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও, রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তার নাম কবিতা।’ তাঁর দেওয়া সংজ্ঞাটি বেশ জটিল এবং তিনি এর কোনো পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেননি।
কবি সিকান্দার আবু জাফর বলেছেন, ‘আমি কবিতা লিখি অনায়াসে । যেমন সকলেরই ক্ষেত্রে জীবনের আশে-পাশে অসংখ্য সুলভ-দুর্লভ মুহূর্ত নানা রূপে অনাবৃত হয়েছে আমার সামনে। আমি কোনো কোনো সময় সেই সব মুহূর্তের স্বাক্ষর লিপিবদ্ধ করেছি সত্য-বিচ্যুতি না ঘটিয়ে। সেই আমার কবিতা।’ এটি খুব অর্থপূর্ণ একটি সংজ্ঞা এবং সহজেই বোধগম্য। এই আলোচনা থেকে বুঝতে পারি, আমার চোখের সামনে যা কিছু দেখি এবং অনুভব ও কল্পনা করে যা সৃষ্টি হয়, তাই কবিতা।
কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘কবিতা বোঝার বিষয় নয়, এটাকে অনুভব করতে হয়। কারণ কবি সম্ভবত বুঝেসুঝে কবিতা লেখেন না, কেবল বিষয়কে সামনে রেখে তাকে অনুভব করেই কবিতার জন্ম হয়।’ কবিতা নিয়ে তিনি খুব সহজ একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। এখানে তিনি কবিতাকে খুব সহজ করে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর সংজ্ঞায় বোঝা যায়, কবিতা জটিল কিছু নয়। মানুষের মনের আবেগ ও অনুভূতির কাব্যিক প্রকাশ হলো কবিতা।
কবি সৈয়দ শামসুল হকের মতে, ‘কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ। সর্বোত্তম ভাবের সঙ্গে সর্বোত্তম শব্দের সংযোগই পারে সর্বোত্তম কবিতা সৃষ্টি করতে।’ এই সংজ্ঞাটি অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। পৃথিবীর কিছু বিখ্যাত কবিদের দেওয়া সংজ্ঞার সঙ্গে তাঁর এই সংজ্ঞার কিছু মিল পাওয়া যায়।
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘যে লেখাটি সমকালের স্মৃতি বা স্বপ্নকে তুলে আনতে সক্ষম এবং একই সঙ্গে সমকালকে অতিক্রমের যোগ্যতা রাখে, তাকেই বোধ হয় কবিতা বলা যেতে পারে।’ তিনি কিছুটা সংশয় নিয়ে কবিতার সংজ্ঞাটি দিয়েছেন। তবে তাঁর দেওয়া সংজ্ঞা বেশ স্বতন্ত্র ও অর্থবহ। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, কবিতা সমকালকে তুলে ধরতে সক্ষম এবং ভবিষ্যতের ভাবনায় বিচরণ করতে পারে।
বিখ্যাত কবিদের দেওয়া কবিতার সংজ্ঞা থেকে কবিতার সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি, কবিতা হলো উপলব্ধি বিষয়। আমার ধারণা মতে কবির অন্তরে সুগভীর চিন্তা ভাবনার পর সুসজ্জিত ও অলংকৃত শব্দ বিন্যাস এবং কাব্যিক ছন্দ বিন্যস্ত কিছু বাক্যের মাধ্যমে কবিতার জন্ম হয়।
কবি জীবনানন্দ দাশের মতে ‘কবিতা লেখলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’। অর্থাৎ কাব্যলক্ষী যার উপর কৃপা করেন তিনিই হলেন কবি। কবিতার রূপের জন্য বিভিন্ন নিয়মনীতি অনুসরণ করা জরুরি।
কবির কবিতা চিরকাল স্বাধীন ভাবনায় উন্মুক্ত চেতনার চলবে, সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা বা গন্ডির মাঝে কবিতাকে কখনো আবদ্ধ করা উচিৎ নয়।
কাঠালিয়ায় দু’দিন ব্যাপী সাহিত্য সম্মেলনের সফলতা কামনা করছি, কৃতজ্ঞ চিত্তে কাঠালিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ঝালকাঠি কবিতা চক্র ও আয়োজকদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি এবং উপস্থিত সকল কবি সাহিত্যিকদের প্রতি প্রাণঢালা অভিনন্দন রইলো।
লেখক-ডা: জহিরুল ইসলাম বাদল, গীতিকার, সুরকার, কবি ও কথা সাহিত্যিক।