তানজিম সাকিব কি ‘ধ্রুজ মুসলমান’?
- আপডেট সময় : ০১:০৬:৪৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ৩৮৭ বার পড়া হয়েছে

তানজিম সাকিব কি ‘ধ্রুজ মুসলমান’?
জাতীয় ক্রিকেট দল থেকে নয়া খেলুড়ে তানজিম হাসান সাকিবকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বিসিবি যতো সময় নষ্ট করবে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ক্রিকেট দলের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ততো বেশি ক্ষুন্ন হবে। তাকে দলে রাখার ল্যাংড়া যুক্তি যতোই দেখানো হোক, প্রমাণিত জঙ্গিমনস্ক কাউকে ক্রিকেট দুনিয়া সমর্থন করে না। ফেসবুকের এক স্ট্যাটাসে সাকিব লেখেন, ‘ইসলামের অনুসারীরা বাদে বাকিরা কাফের, তাদের রক্ত হালাল।’ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ক্রিকেটীয় সম্মান নষ্ট হওয়ার আগে জাতীয় দলের লিটন দাশ, সৌম্য সরকারদেরকেও সাকিব মনস্কদের থেকে রক্ষা করা, নিরাপদ রাখা জরুরি। মনোবিদের পরামর্শে উগ্রচিন্তার সাকিবের উদারনৈতিক চিন্তার প্রকৃত ধার্মিকে রূপান্তর ঘটবে, এগুলো যারা বলছেন, তারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। সাকিবের পক্ষে ওকালতি করছেন।
পৃথিবীর প্রধানতম প্রায় সব ধর্মের ‘রাজনৈতিক সংস্করণ’ আছে। এর প্রবক্তা রাজনীতিকরা। সনাতন ধর্মের রাজনৈতিক সংস্করণের ওপর নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ নির্ভর করেন বলে তাদের সরকারের আমলে ভারতে শুধু মুসলমান হওয়ার অপরাধে আকলাকরা (ঘরে গরুর মাংস রাখার সন্দেহে) হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। অথচ সনাতন ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নানামতের সহাবস্থান ও আধ্যাত্মিকতাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার। আরেক প্রতিবেশি মিয়ানমারে মুসলমান রোহিঙ্গাদের ওপর চলা গণহত্যাকেও দেশটির বেশ কয়েক ভিক্ষু সমর্থন করেন তারা বৌদ্ধ ধর্মের রাজনৈতিক সংস্করণে বিশ্বাসী বলে। ক্ষুদ্রতরো প্রাণিকেও অকারণে হত্যায় মহাপাপ হিসেবে ঘোষণা দেয় বৌদ্ধমত। পূর্ণিমার চাঁদের মতো স্নিগ্ধ শিখধর্মের ভুল ব্যাখ্যার নৃশংস রূপও ভারতে দেখেছি আমরা। এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কায় শুভ্র শান্তির খ্রিষ্টধর্মের রাজনৈতিক বিকৃতি ঘটিয়ে মুসলমান নিধনযজ্ঞও আমরা ভুলিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতিতে সামনের সারিতে থাকা দেশে খ্রিষ্টধর্মের রাজনৈতিক সংস্করণের ফের প্রসার ঘটিয়ে সেখানকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রগতিশীল সমাজকে ক্ষত-বিক্ষত করে তোলেন। তাঁর শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রে ‘এন্টিসেমিটিজম’ (ইহুদিবিদ্বেষ) ভয়ংকর আকার ধারণ করে। ব্রাজিলের উদারনৈতিকতায় বিশ্বাসী খ্রিষ্টানদের একটা অংশকে ‘ইভানজেনিক্যাল’দের মতো কট্টরপন্থী করে তোলে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর সরকারের প্রচারিত খ্রিষ্টধর্মের রাজনৈতিক সংস্করণ। ইসলামের রাজনৈতিক সংস্করণের সবশেষ ভয়ংকর রূপ আমরা দেখেছি আইএসের সভ্যতাবিরোধী বর্বরতায়। ইসলামের রাজনৈতিক সংস্করণ নিয়ে তানজিম হাসান সাকিবকে যদি একটানা ছয়মাস লিখতে বলা হয়, তিনি কি আদৌ রাজি হবেন? মনোবিদের পরামর্শে তার ধর্মীয় উগ্রচিন্তার পরিবর্তন ঘটবে, এ ধরনের আশাবাদ মরিচিকার নামান্তর।
কেউ কেউ বলছেন, তানজিম যখন ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রবাদ প্রচার করতেন, তখনো তার বয়স বিবেচনায় সাবালকত্ব আসেনি। এগুলো ফাঁও যুক্তি। দেশের প্রচলিত আইনে বয়স আঠারো না হলে কেউ নাবালক। ধর্মপালনের বয়সের সঙ্গে দেশের প্রচলিত আইনে সাবালক হওয়ার সম্পর্ক নেই। আইন অনুযায়ী সাবালক হওয়ার আগেই ধর্মপালনের বয়স আসে। ধর্মের বিধান না মানলে পাপ, আইন না মানলে অন্যায় হয়। পাপ ও অন্যায় আলাদা বিষয়। বিশ্বাসের নিরিখে একটার বিচার করেন স্রষ্টা, অন্যটার বিচার করে রাষ্ট্র। ধর্মের অনুসারী ও নাগরিক হওয়ায় দুটিকেই মেনে চলতে হয়। দুটিকেই মেনে চলার কথা কোরান, হাদিস, ইজমা, কিয়াসেও প্রমাণিত। যে বয়সে ধর্মশিক্ষা নেয়ার কথা, সেই বয়সে তানজিম উগ্রবাদ আত্মস্থ করেন। গবেষণা প্রমাণ দেয়, জঙ্গিবাদে জড়ানোর বয়সও সেটাই। ২০২২ সালে ফেসবুকে উগ্রবাদ প্রচারের সময়ও তার বয়স আঠারোর বেশি ছিলো, এখন বয়স বিশ।
আরেকটা বিষয়, তানজিম নিশ্চয় ‘ধ্রুজ মুসলমান’ নন। ধ্রুজ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অনেকে চল্লিশ বছরের আগে ধর্মকর্ম করেন না, এর আগে তারা ধর্মচিন্তায় নাবালক থাকেন। কারণ, মুহাম্মদ (সা.) চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়াতপ্রাপ্ত হন বলে তারা ওই বয়সের পর ধর্ম পালন শুরু করেন। ‘ধ্রুজ’ হলে তানজিমকে ‘নাবালক’ ভেবে নেয়ার সুযোগ ছিলো। আর অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের সমসাময়িক বাস্তবতায় ইসলাম নারীকে সম্মান দেয় বলেই মুহাম্মদের (সা.) আমলে আরবের অনেক নারী আগের ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হন। মুহাম্মদের (সা.) প্রথম স্ত্রী খাদিজা (রা.) সেই যুগে আরবের ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি চৌদ্দশত বছর আগে যা অর্জন করেন, তা আজকের দিনেও হতে পারে অসংখ্য নারীর আকাঙ্খার বিষয়। আরেক স্ত্রী আয়েশা (রা.) যুদ্ধের মাঠেও অংশ নেন। আয়েশা (রা.) প্রতি বছর হজে দূরদূরান্তের জ্ঞানপিপাসু শুধু নারীদেরই নয়, পুরুষদেরও শিক্ষা দিতেন। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের জ্ঞান লাভ করেন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুহাম্মদের (সা.) দরবারে আসা আরব গোত্রের প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে। ইসলামের নামে প্রচারিত নারীবিদ্বেষী অনেক তথ্যই ভুয়া। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সেসবকে সমর্থন করে না।●
লেখক: হাসান শান্তনু, সিনিয়র সাংবাদিক।
















