কর্তার জন্মদিন; শচীন কর্তার ছোঁয়া তুমি যে গিয়াছো বকুলও বিছানো পথে
- আপডেট সময় : ০১:৩৭:৫৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১ অক্টোবর ২০২৩ ২২৭ বার পড়া হয়েছে

শচীন দেব বর্মণ -এর সাথে দেখা সেই শৈববে। গ্রামের বাড়ি হাটখোলায়, গ্রামোফোন রেকর্ডে। দাদার ছিলো ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েজ’ গ্রামোফোন। গানের সাথে পরিচয় সেই থেকেই। কতবার শুনেছি, ‘তুমি যে গিয়াছো বকুলও বিছানো পথে।’ কুমিল্লা শহরে বেড়ে উঠেছি, যখনই চর্থা গিয়েছি, তাকিয়ে দেখেছি নবদ্বীপ বর্মণের বাড়িটি, এখানেই উপমহাদেশের সংগীতের কিংবদন্তি শচীন কর্তা জন্ম নিয়েছিলেন।
তাঁর শৈশব থেকে যৌবন কেটেছে আমাদের কুমিল্লা শহরে। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর পাকিস্তান সরকার এখানে গড়ে তোলেন হাঁস মুরগীর খামার। বিশাল বাড়ি আশে পাশে দখল করে নিয়েছে কিছু ভূমিদষ্যু। আবহেলা অনাদরে খসে পড়েছে বাড়ির পাঁজর। দেশ স্বধীন হবার পর থেকেই আমাদের দাবি ছিল, বাড়িটি অবমুক্ত করা হোক। অবশেষে কুমিল্লার সচেতন মানুষ সোচ্চার হয়ে অবমুক্ত করেছে সেই অবহেলিত পুন্য ভূমিকে। গড়ে উঠেছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়, শচীন দেব বর্মণ স্মৃতি যাদুঘর। এখানে এখন অক্টোবরে বসে, শচীন দেব বর্মণ স্মৃতি মেলা।
স্বপ্নের বাঁশি ওয়ালা নবদ্বীপচন্দ্র বর্মণ একজন সেতার বাদক ও ধ্রুপদী গানের শিল্পী, ত্রিপুরা রাজ বংশের ছেলে। পারিবারিক কোন্দল, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং জীবননাশের আশংকা হেতু নবদ্বীপচন্দ্র’কে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চর্থায় প্রসাদপোম বাড়ি, তিনি এ’দিকের সবকিছু দেখাশুনা করতেন। তার ঘরে মুখ উজ্বল করে, ১ অক্টোবর ১৯০৬ সালে জম্ম নিলেন শচীন দেব বর্মণ। বাড়িতে পিতা, বাড়ির পরিচারক মাধব ও আনোয়ারের নিকট সঙ্গীতের হাতেখড়ি। ফর্সা ছিপছিপে গড়ন। ‘
২০ সালে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ‘২৪ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ, চলে যান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। গান বাজনার পাশাপাশি ভাল ফুটবল, ক্রিকেট ও টেনিস খেলতেন। টেনিসে ছিলেন পারদর্শী। একরাতে দারুণ আড়বাঁশি বাজাতেন ও দেশজ গান গাইতেন, কখনো জিলা স্কুলের বড় অশ্বত্থ গাছের নিচে সামনে অবারিত ধর্মসাগর, কখনো বাড়ির সামনে নানুয়া দিঘির পাড়ে। তেমনি এক রাতে কৈশোরের বন্ধু, মর্তুজ মিয়া সহ পথে হাঁটতে হাঁটতে গুন গুন করে গাইছিলেন। কুমিল্লার নওয়াব নাবালক মিয়া বারান্দায় বসে ছিলেন, গান শুনে সফর আলীকে বললেন, ছেলেটা কে? ডেকে নিয়ে আয়।
‘কর্তা, আপনাকে হজুর ডাকছে’। শচীন কিছুটা বিচলিত হলেন। ‘তোর তো গলা ভালোই, বাড়িতে তবলা হারমোনিয়াম আছে?’ শচীনের না সুচক জবাব পেয়ে, নওয়াব বাড়িতে গানের আনুসাঙ্গিক কিনে, একটা কামরা দিয়ে বললেন, এখন থেকে এখানে তুই গানের চর্চা করবি। কানাই নামে রেখে দিলেন এক তবলচি। সেই দিন থেকে শুরু হলো শচিন দেব বর্মণের উত্থান। কুমিল্লা তখন সেই সময় কুমিল্লা থেকে সঞ্জয় ভট্টাচার্য, অজয় ভট্টাচার্য পূর্বাশা নামে সাহিত্য পত্র প্রকাশ করেন, ছাপাখানা সিংহ প্রেস। সুর সাগর হিমাংশু দত্ত সহ অনেকেই কুমিল্লায় ছিলেন।
কবি নজরুল ইসলাম কুমিল্লা এসেছেন বার কয়েক। বসতো গানের জলসা। শচীন দেব কে ভালোবাসি সেই শৈশব থেকে। বাড়িতে কলের গানে গান শুনেছি। ‘তুমি যে গিয়াছ বকুলও বিছানো পথে’। অনেক মনে পড়ে, ‘প্রেম যমুনায় হয়তো বা কেউ, ঢেউ দিলো ঢেউ দিলো রে, অাকুল হিয়ার দু’কূল বুঝি ভাঙলো রে’। কলেজে পড়ার সময় অনেকের সাথে আমার হৃদ্যতা হয়, তেমনি বজ্রপুর, ইউসুফ স্কুল রোড, নানুয়ার দিঘীর পাড়ের বেশ কয়েক জনের সাথে হয় ভালো সম্পর্ক। সহপাঠী কাওসারের সাথে মাঝে মাঝে ওখানে যাই। কাওসারের বাড়ি পেরিয়ে একটু দক্ষিণে এগুলেই চর্থা শচীন কর্তার বাড়ি। ইউসুফ স্কুলের সামনে সাধন বাবুর চা দোকানে চলতো আমাদের জমজমাট আড্ডা। মনোরমা দেবী ১৯৭৪ সালের কথা। পাশেই ‘শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালী বাড়ি’।
ভার্সিটি ছুটি হলে কুমিল্লা চলে যাই, চলত আমাদের চুটিয়ে আড্ডা। কালী বাড়ির সেবায়েত মনোরমা দেবী, মন্দিরের পাশে ছোট একটা রুমে থাকেন। বয়স তখন প্রায় ৬৫, বোঝাই য়ায়, যৌবনে রূপবতী ছিলেন। ১৩ বৎসর বয়সে পটিয়া থেকে এখানে আসেন, মন্দিরের পুরোহিতের নববধু হয়ে। কর্তার ছোঁয়া মন্দিরের ভিতরে কালী দেবীর সামনে একটা পাকা বারান্দা আছে। কিছু কিছু দ্রব্যগুন, তাস নিয়ে আমরা কয়েক জন সেই বারন্দায় প্রায়ই বসেছি আড্ডায়। মাসি সকাল সন্ধ্যায় ধুঁপের আরতি সাজিয়ে নিবিষ্ট মনে পূজা অর্চণা করতেন।
কখনো পাশে এসে বসেছেন। গল্পে ফিরে যান, সেই ১৯২১ সালে। ১৩ বছর বয়সে কুমিল্লা চলে আসেন পটিয়া ছেড়ে, এখানে এসে পেয়েছেন, উপমহাদেশর প্রখ্যাত সব শিল্পীর সান্নিধ্য। সবার সাথে শেয়ার করতেন না, আমি লেখালিখি করি তাই আমাকে মনোরমা মাসির বেশ পছন্দ। একদিন সন্ধ্যায় কিছু বৃষ্টি হচ্ছিল, মনোরমা মাসির মনটা আনমনা হয়ে গেলো, মেলে ধরলেন স্মৃতির হারানো পাতা। মাসি একটা গান গাও, শুনি, তোমার মন ভালো নেই, একটা গান করো তোমার সেই স্মৃতি থেকে। মন ভালো হয়ে যাবে। মাসি কল্কিতে আগুনটা দিয়ে বললেন, তোদের কতো সৌভাগ্য।
এই হাতে তামাক সাজিয়ে দিয়েছি, তোদের শচীন কর্তার হাতে আজ থেকে ৪৫ বৎসর আগে, সেই হাতের ছোঁয়াটা দিয়ে গেলাম আজ তোর হাতে। ‘চেওনা সুনয়না আর চেওনা এই নয়ন পানে’ খালি গলায় গাইলেন, বাইরে হালকা বৃষ্টি মাসির চোখে জল ছল ছল যেন বৃষ্টি, ‘কর্তা গাইতেন, আমি সাথে হারমোনিয়াম বাজাতাম।’ ‘মনোরমা, আমার সাথে গাও, তোমার গানের গলাটা বেশ’। সাথে তবলা বাজাতেন ওস্তাদ খসরু।
কি আনন্দের দিন ছিল। শুনেছি কর্তা নাকি অসুস্থ অনেক দিন শয্যাশায়ী, বাংলাদেশে আসবে বলেছিল।’ মাসি তোমারা যখন গাইতে, মেসো মশাই তখন কি করতেন? আরে তোর মেসোর কথা অার বলিস না, সে এ’সবের যোগান দিত, খুব ফুর্তিবাজ ছিল মানুষটা।’ এমন সময় বৃষ্টি আরো বেপরোয়া হয়ে এলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সেদিন চলে এসেছিলাম। শচীন কর্তার ছোঁয়া নিয়ে। লেখক: শওকত আহসান ফারুক কথা সাহিত্যিক।











