সংবাদ শিরোনাম ::
শাহজাদপুরে আওয়ামীলীগের সাবেক দুই এমপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা বেলকুচিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ  শাহজাদপুরে অটোবাইক ছিনতাই চক্রের ৬ জন আটক ৭ নভেম্বর না আসলে বাংলাদেশ বিলীন হয়ে যেত: বাউবি উপাচার্য বেলকুচির সেন ভাঙ্গাবাড়ী বাজার মসজিদের নির্মাণ কাজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন “জয় বাংলা” স্লোগান দেওয়ায় সাবেক পিপি-কে গণপিটুনি, পুলিশে সোপর্দ উলিপুরে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ভোট কেন্দ্র মেরামতের টাকা আত্নসাতের অভিযোগ খাজা শাহ্ এনায়েতপুরী (রহ:) এর ১১০ তম ওরছ শরীফের দাওয়াত পত্র বিতরণ  রাজশাহীর মাঠে স্পীড স্কেটিংয়ে বগুড়ার স্কেটারদের ৩টি স্বর্ণপদক সহ ৮ পদক অর্জন এনায়েতপুরে ৭ই নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি উপলক্ষে আলোচনা সভা

রাধাপদের বুকে তীর মেরোনা; ওকে গাইতে দাও

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০২:১৭:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ অক্টোবর ২০২৩ ৮২৬ বার পড়া হয়েছে

কবি রাধাপদ রায় একজন গীতিকবি। নদীর দেশ কবিতার দেশ সুরের দেশের সেই মনের মানুষ; আজকের এই ঘাতক সমাজে যে গাতককে খুঁজে ফিরি আমরা।

অসুরের মানুষেরা অশীতিপর এই সুরের মানুষকে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। সমাজে অসুরের দোর্দণ্ড প্রতাপে এর আগে আমরা একজন প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাকে লাথি দিতে দেখেছিলাম। এসবই অসভ্য সমাজের দগদগে ঘা; যা নক্সী পাঞ্জাবি পরিয়ে ঢেকে রাখলেও বেরিয়ে পড়ে। একবার এক ইউএনওকে দেখেছিলাম, এক প্রবীণকে কান ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক বৃদ্ধ সবজি বিক্রেতা স্যার না বলায় তাকে চড় কষে দিয়েছিলেন আরেক ইউএনও।

আমি যখন ঘুরে ফিরে ইউরোপের সভ্য সমাজের উদাহরণ টেনে আনি; তখন আমার উপনিবেশবাদ বিরোধী গবেষক ও লেখক বন্ধুরা আমাকে পশ্চিম প্রভাবিত লেখক মনে করেন।

ইউরোপে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য সমাজে রক্ষাকবচ; এমনকী তরুণদের মাঝে প্রবীণদের সহযোগিতা করার মনোভাব; ট্রামে উঠে দাঁড়িয়ে বসতে দেয়া; কেউ রাস্তায় পড়ে গেলে তাকে সেবা করার মনোভঙ্গি দেখে; তাদের মধ্যে সভ্যতার সুচিহ্ন প্রত্যক্ষ করেছি। পশ্চিমা সমাজে লম্বা করে সালাম, নমস্কার দেয়া বা কদমবুচি করার লোক দেখানো শ্রদ্ধার সুনামি নেই। যা আছে তা হচ্ছে গভীর বোধ।

কবি রাধাপদ রায় একজন সিনিয়র সিটিজেন, তাঁকে কবি পরিচয় বা ধর্ম পরিচয় দিয়ে বিশিষ্ট করে তোলার প্রয়োজন আমার নেই। উনি সিনিয়র সিটিজেন; শুধু এই পরিচয়ের কারণেই; এটা প্রতীয়মান যে; অপরাধীরা কঠোর শাস্তিযোগ্য। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া সমাজ সংস্কার হয়না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি মানে অপরাধীকে ক্রসফায়ারে দেয়া বা গণপিটুনী দেয়া নয়; তাকে সংশোধনকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। অসভ্য সমাজে যেটা এখনো গুলাগ হয়ে আছে। এই সমাজে চোখে বদলে চোখ, চামড়ার বিনিময়ে চামড়া তুলে নেবার চল; মুহূর্তের উত্তেজনা শিথিল করে তাতক্ষণিক প্রতিশোধে। ফলে যে অপরাধটি সংঘটিত হয়; তা নিয়ে আলোচনার চেয়ে অপরাধীর গুষ্টি উদ্ধারে কেটে যায় সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়ালের শুনানির সময়টুকু।

দেশের শীর্ষ নেতা লন্ডনে তাঁর এক বক্তৃতায় নিজে সিনিয়র সিটিজেন হয়ে আরেকজন সিনিয়র সিটিজেন সম্পর্কে যে ভাষায় নিষ্ঠুরতা ও পরচর্চার সংস্কৃতি মেলে ধরেছেন; তাতে এ সমাজে সিনিয়র সিটিজেন সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সভ্যতা প্রবর্তন আরো কঠিন হয়ে গেলো।

তবু এতো আমাদেরই সমাজ; এখানে ভুল দৃষ্টান্তগুলোকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করে সভ্যতার পথে হাঁটতে হবে আমাদের। নিজস্ব বোধ বিবেচনা আর মনুষ্যত্বের আলোয় দীপিত করতে হবে ধেয়ে আসা অন্ধকার।

সমাজের সহিংস মনোভাবের বিপরীতে অহিংসার প্রতিরোধ আমরা পেয়েছি লালন, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিমের গীতিকবিতায়। কবি রাধাপদ রায় সেই অহিংস ধারার সুরের মানুষ। তার ওপর থাগস অফ বেঙ্গলের এই হামলা; আসলে আমাদের সমাজ মননের অহিংস ধারার ওপর হামলা।

এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাচালি শুনে কান ঝালাপালা হয়ে যায়; শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি করে লাক ফেরান বিদূষক শিল্পীরা। তারা ভুলে যান দেশের প্রত্যন্তের শিল্পীদের কথা। বাংলাদেশের বাউল ও লোকগানের ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতির জাদুঘরের মতো যে মানুষগুলো; যারা সুরের শেষ চিহ্ন; তারা দারিদ্র্যের অগমে দুর্গমে ম্রিয়মাণ।

এদেশে ওয়াজ-মেহেফিলের অতিথির জন্য হেলিকপ্টার আছে, ধর্মানন্দের পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা আছে, সরকারী স্তবসংকীর্তনের জন্য সংস্কৃতি মামাদের জন্য পদ-পদবী-প্লট আছে; বেসুরো গানের জন্য লক্ষ লক্ষ ভিউ ও গুগল মানি আছে।

শুধু কেউ নেই এই স্বভাব কবি বাউলদের; যারা অতীতে মাধুকরী করে জীবন কাটাতো। কিন্তু এই দুর্নীতি ও বিকৃতির যুগে পাপী সমাজ বাউল গান শুনতে চায় না। তারা মসজিদে ও মন্দিরে পাপ স্খলনের জন্য মাথা ঠুকে। কিছু উগ্র ধর্ম ব্যবসায়ী মোল্লা আবার এক ধাপ এগিয়ে “সংগীত হারাম” বলে ফতোয়া দেয়। নও মুসলিমের দেড় ইটের মসজিদ গড়ার এই লালসালু গ্রামে এইটা ঐটা হারাম বলে দেয়া যায় কত সহজেই। অথচ বাংলাদেশে ইসলাম জনপ্রিয় হয়েছিলো সুফি গায়ক ও সাধকদের সাম্য আর শান্তির আহবানে।

এই সবুজ বদ্বীপ, যেখানে গান জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা রক্তপ্রবাহের মতো; সেইখানে এখন গান অর্থ তা-লেবান ও বালেবানের কাটা রাইফেল; চর দখলের যুদ্ধাস্ত্র। এইসব সহিংস স্থূল লালসার লালামাখা ধর্ম ব্যবসায়ী ও রাজনীতি ব্যবসায়ীদের থামাতে হবে। জায়গা করে দিতে হবে সত্য সুন্দরকে।

রাধাপদ রায়ের মতো গীতিকবিদের মাঝে বহমান আমাদের কৃষিঘন সরল জনপদের আনন্দধারা। একে রক্ষা করতে হবে। সুন্দরকে বাঁচানোর দায়িত্ব প্রতিটি মানুষের।

লেখক: মাসকাওয়াথ আহসান এডিটর ইন চীফ, ইসাউথ এশিয়া

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

রাধাপদের বুকে তীর মেরোনা; ওকে গাইতে দাও

আপডেট সময় : ০২:১৭:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ অক্টোবর ২০২৩

কবি রাধাপদ রায় একজন গীতিকবি। নদীর দেশ কবিতার দেশ সুরের দেশের সেই মনের মানুষ; আজকের এই ঘাতক সমাজে যে গাতককে খুঁজে ফিরি আমরা।

অসুরের মানুষেরা অশীতিপর এই সুরের মানুষকে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। সমাজে অসুরের দোর্দণ্ড প্রতাপে এর আগে আমরা একজন প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাকে লাথি দিতে দেখেছিলাম। এসবই অসভ্য সমাজের দগদগে ঘা; যা নক্সী পাঞ্জাবি পরিয়ে ঢেকে রাখলেও বেরিয়ে পড়ে। একবার এক ইউএনওকে দেখেছিলাম, এক প্রবীণকে কান ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক বৃদ্ধ সবজি বিক্রেতা স্যার না বলায় তাকে চড় কষে দিয়েছিলেন আরেক ইউএনও।

আমি যখন ঘুরে ফিরে ইউরোপের সভ্য সমাজের উদাহরণ টেনে আনি; তখন আমার উপনিবেশবাদ বিরোধী গবেষক ও লেখক বন্ধুরা আমাকে পশ্চিম প্রভাবিত লেখক মনে করেন।

ইউরোপে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য সমাজে রক্ষাকবচ; এমনকী তরুণদের মাঝে প্রবীণদের সহযোগিতা করার মনোভাব; ট্রামে উঠে দাঁড়িয়ে বসতে দেয়া; কেউ রাস্তায় পড়ে গেলে তাকে সেবা করার মনোভঙ্গি দেখে; তাদের মধ্যে সভ্যতার সুচিহ্ন প্রত্যক্ষ করেছি। পশ্চিমা সমাজে লম্বা করে সালাম, নমস্কার দেয়া বা কদমবুচি করার লোক দেখানো শ্রদ্ধার সুনামি নেই। যা আছে তা হচ্ছে গভীর বোধ।

কবি রাধাপদ রায় একজন সিনিয়র সিটিজেন, তাঁকে কবি পরিচয় বা ধর্ম পরিচয় দিয়ে বিশিষ্ট করে তোলার প্রয়োজন আমার নেই। উনি সিনিয়র সিটিজেন; শুধু এই পরিচয়ের কারণেই; এটা প্রতীয়মান যে; অপরাধীরা কঠোর শাস্তিযোগ্য। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া সমাজ সংস্কার হয়না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি মানে অপরাধীকে ক্রসফায়ারে দেয়া বা গণপিটুনী দেয়া নয়; তাকে সংশোধনকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। অসভ্য সমাজে যেটা এখনো গুলাগ হয়ে আছে। এই সমাজে চোখে বদলে চোখ, চামড়ার বিনিময়ে চামড়া তুলে নেবার চল; মুহূর্তের উত্তেজনা শিথিল করে তাতক্ষণিক প্রতিশোধে। ফলে যে অপরাধটি সংঘটিত হয়; তা নিয়ে আলোচনার চেয়ে অপরাধীর গুষ্টি উদ্ধারে কেটে যায় সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়ালের শুনানির সময়টুকু।

দেশের শীর্ষ নেতা লন্ডনে তাঁর এক বক্তৃতায় নিজে সিনিয়র সিটিজেন হয়ে আরেকজন সিনিয়র সিটিজেন সম্পর্কে যে ভাষায় নিষ্ঠুরতা ও পরচর্চার সংস্কৃতি মেলে ধরেছেন; তাতে এ সমাজে সিনিয়র সিটিজেন সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সভ্যতা প্রবর্তন আরো কঠিন হয়ে গেলো।

তবু এতো আমাদেরই সমাজ; এখানে ভুল দৃষ্টান্তগুলোকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করে সভ্যতার পথে হাঁটতে হবে আমাদের। নিজস্ব বোধ বিবেচনা আর মনুষ্যত্বের আলোয় দীপিত করতে হবে ধেয়ে আসা অন্ধকার।

সমাজের সহিংস মনোভাবের বিপরীতে অহিংসার প্রতিরোধ আমরা পেয়েছি লালন, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিমের গীতিকবিতায়। কবি রাধাপদ রায় সেই অহিংস ধারার সুরের মানুষ। তার ওপর থাগস অফ বেঙ্গলের এই হামলা; আসলে আমাদের সমাজ মননের অহিংস ধারার ওপর হামলা।

এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাচালি শুনে কান ঝালাপালা হয়ে যায়; শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি করে লাক ফেরান বিদূষক শিল্পীরা। তারা ভুলে যান দেশের প্রত্যন্তের শিল্পীদের কথা। বাংলাদেশের বাউল ও লোকগানের ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতির জাদুঘরের মতো যে মানুষগুলো; যারা সুরের শেষ চিহ্ন; তারা দারিদ্র্যের অগমে দুর্গমে ম্রিয়মাণ।

এদেশে ওয়াজ-মেহেফিলের অতিথির জন্য হেলিকপ্টার আছে, ধর্মানন্দের পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা আছে, সরকারী স্তবসংকীর্তনের জন্য সংস্কৃতি মামাদের জন্য পদ-পদবী-প্লট আছে; বেসুরো গানের জন্য লক্ষ লক্ষ ভিউ ও গুগল মানি আছে।

শুধু কেউ নেই এই স্বভাব কবি বাউলদের; যারা অতীতে মাধুকরী করে জীবন কাটাতো। কিন্তু এই দুর্নীতি ও বিকৃতির যুগে পাপী সমাজ বাউল গান শুনতে চায় না। তারা মসজিদে ও মন্দিরে পাপ স্খলনের জন্য মাথা ঠুকে। কিছু উগ্র ধর্ম ব্যবসায়ী মোল্লা আবার এক ধাপ এগিয়ে “সংগীত হারাম” বলে ফতোয়া দেয়। নও মুসলিমের দেড় ইটের মসজিদ গড়ার এই লালসালু গ্রামে এইটা ঐটা হারাম বলে দেয়া যায় কত সহজেই। অথচ বাংলাদেশে ইসলাম জনপ্রিয় হয়েছিলো সুফি গায়ক ও সাধকদের সাম্য আর শান্তির আহবানে।

এই সবুজ বদ্বীপ, যেখানে গান জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা রক্তপ্রবাহের মতো; সেইখানে এখন গান অর্থ তা-লেবান ও বালেবানের কাটা রাইফেল; চর দখলের যুদ্ধাস্ত্র। এইসব সহিংস স্থূল লালসার লালামাখা ধর্ম ব্যবসায়ী ও রাজনীতি ব্যবসায়ীদের থামাতে হবে। জায়গা করে দিতে হবে সত্য সুন্দরকে।

রাধাপদ রায়ের মতো গীতিকবিদের মাঝে বহমান আমাদের কৃষিঘন সরল জনপদের আনন্দধারা। একে রক্ষা করতে হবে। সুন্দরকে বাঁচানোর দায়িত্ব প্রতিটি মানুষের।

লেখক: মাসকাওয়াথ আহসান এডিটর ইন চীফ, ইসাউথ এশিয়া