পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর গর্ত, প্রতীকী ছবি
পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর গর্ত’

- আপডেট সময় : ০৫:২৭:০৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩ ৭৭ বার পড়া হয়েছে

বাংলা পোর্টাল: রাশিয়ার কোলা পেনিনসুলা। এই অঞ্চলের লেক, বন, কুয়াশা ও বরফের আস্তরণ আপনাকে রূপকথা কিংবা ফ্যান্টাসি গল্পের কোনো দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেবে। চোখধাঁধানো এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে হঠাৎই চোখে পড়বে পরিত্যক্ত এক রাশিয়ান গবেষণাগারের ধাতব কাঠামো। বিল্ডিংটির মাঝখানে কংক্রিটের মধ্যে দেখা যায় মরচে পড়া ভারী এক ধাতব ঢাকনা। প্রকাণ্ড কিছু মরচে পড়া খিল লাগানো আছে ওটার গায়ে। কারও কারও মতে, এটাই নরকের দরজা।
আসলে ঢাকনার ওই পাশে আছে পরিত্যক্ত এক গভীর গর্ত। যেখানে মানুষ অশরীরীদের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ায়। গুগলে মাঝেমধ্যেই সার্চ করা হয় ‘কোলা সুপারডিপ বোরহোল স্ক্রিম’ লিখে। লোকে বলে, ওই ঢাকনা ভেদ করে নাকি ভেসে আসে নরকের অত্যাচারিত আত্মাদের অস্বাভাবিক চিৎকার।
এসবই মানুষের কল্পনা। গর্তটি এখন পরিত্যক্ত। গভীর অন্ধকার এই গর্তে পড়ে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। ভেতর থেকে কোনো চিৎকারও ভেসে আসে না। এটিই মানুষের খোঁড়া সবচেয়ে গভীর গর্ত।
১৯৯২ সালে গর্ত খোঁড়া বন্ধ হয়ে গেছে। এর এক যুগ পর পরিত্যক্ত হয়েছে জায়গাটি। ধীরে ধীরে সময়ের স্রোতে ভরাটও হয়ে গেছে এর অনেকখানি। গর্তটির ব্যাস মাত্র ৯ ইঞ্চি। গভীরে ১২ দশমিক ২৬২ কিলোমিটার। এই গভীরতায় যেতে মানুষের ২০ বছর লেগেছে।
গত পাঁচ দশক ধরে বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর গর্ত খোঁড়ার চেষ্টা করছেন। পৃথিবীর ভূত্বক খুঁড়ে ম্যান্টল পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা চলছে। তাঁরা খুঁড়ে দেখতে চেয়েছেন, পৃথিবীর কতটা গভীরে যাওয়া সম্ভব। আগের রেকর্ড ভেঙে আরও গভীরে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে বারবার।
১৯৫৮ সালে প্রথম পৃথিবীর মধ্যভাগের ম্যান্টল পর্যন্ত গর্ত খোঁড়ার চেষ্টা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। মেক্সিকোর গুয়াদালুপের প্যাসিফিক সমুদ্রে একটি গর্ত খোঁড়া প্রকল্প থেকে শুরু
বিজ্ঞানীরা ভূপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত স্থানকে তিন ভাগে ভাগ করেন। ভূত্বক, ম্যান্টল ও কেন্দ্রমণ্ডল। ভূত্বকে আমরা সবাই নানা রকম গর্ত খুঁড়তে পারি। কিন্তু ম্যান্টল পর্যন্ত যাওয়াটা দুঃসাধ্য।
পৃথিবীর ব্যাসার্ধ প্রায় ৬ হাজার ৩৭১ থেকে ৬ হাজার ৩৫৭ কিলোমিটার। ভূমির ৪০ শতাংশ ম্যান্টল। ভূত্বক ৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার পুরু। এরপর ২ হাজার ৮৯০ কিলোমিটার ম্যান্টল। বাকিটুকু কেন্দ্রমণ্ডল। ম্যান্টলে পৌঁছানোর জন্যই বিজ্ঞানীদের এই দীর্ঘ প্রচেষ্টা। ভূত্বক ভেদ করে যেতে হবে ম্যান্টলে। শুনতে যত সহজ, পৌঁছানো তত সহজ নয়। ভূত্বকের নিচের দিকে তাপমাত্রা এত বেশি যে এখন পর্যন্ত খুঁড়ে ম্যান্টল পর্যন্ত কেউ যেতে পারেনি।
১৯৫৮ সালে প্রথম পৃথিবীর মধ্যভাগের ম্যান্টল পর্যন্ত গর্ত খোঁড়ার চেষ্টা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। মেক্সিকোর গুয়াদালুপের প্যাসিফিক সমুদ্রে একটি গর্ত খোঁড়া প্রকল্প থেকে শুরু। প্রকল্পের নাম প্রজেক্ট মোহোলে। এতে মার্কিন প্রকৌশলীরা সমুদ্রের তলায় ৬০১ ফুট বা ১৮৩ মিটার পর্যন্ত খুঁড়েছিলেন। ওপর দিকে, সমুদ্রের তলা থেকে পানির উপরিভাগ পর্যন্ত দূরত্ব ছিল ১১ হাজার ৭০০ ফুট বা ৩ হাজার ৫৬৬ মিটার। এর মানে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ হাজার ৩০১ ফুট পর্যন্ত গভীরে যাওয়া সম্ভব হয় প্রথম যাত্রায়। এরপর প্রকল্পটি টাকার অভাবে ১৯৬৬ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
প্রশ্ন হলো, ম্যান্টলে কেন যেতে হবে? ভূমির ওপরে মানুষ তো ভালোই আছে। যদি ভেতরে খুব গরম হয়, তাহলে যাওয়ার প্রয়োজন কী? আসলে, আমরা সশরীর যাচ্ছি না। যন্ত্র দিয়ে খুঁড়ে ম্যান্টল পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করছি। কারণ, ম্যান্টলে লেখা আছে পৃথিবীর ইতিহাস। উত্তপ্ত ধুলার মেঘ জমাট বেঁধে কী করে ধীরে ধীরে পৃথিবী গঠিত হলো, তার বিস্তারিত জানা যাবে সেই ইতিহাস দেখে। বলা হয়, পৃথিবীর জন্ম মহাকাশে ছড়ানো ধুলার মেঘ থেকে। নক্ষত্র বিস্ফোরণে ছড়ানো কণা পাওয়া যাবে পৃথিবীর গভীরে। তাই মহাবিশ্ব ও পৃথিবীর ইতিহাস প্রমাণসহ জানার জন্য এ রকম গর্ত খোঁড়া গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদির ব্যাপারেও জানা যাবে বিস্তারিত। তা ছাড়া তেল, গ্যাস আর খনিজ পদার্থ আহরণ তো আছে।
গর্ত খোঁড়ার পরবর্তী চেষ্টা শুরু হয় ১৯৭০ সালে। ২০ বছর ধরে এই চেষ্টা চলে। একদল সোভিয়েত বিজ্ঞানী মার্কিন বিজ্ঞানীদের চেয়ে আরও গভীরে যেতে চাইলেন। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। পৃথিবীর গভীরে যাওয়ার প্রতিযোগিতা সেখান থেকেই শুরু হয়। সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা মার্কিন বিজ্ঞানীদের থেকে বেশি গভীরে যাওয়াটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। ফলাফল ‘কোলা সুপারডিপ বোরহোল’ নামের গভীর গর্ত খোঁড়ার প্রকল্প। সবচেয়ে গভীর সমুদ্রের গভীরতম স্থানের গভীরতা থেকেও এর গভীরতা বেশি। যেমন প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতা ১০ দশমিক ৯ কিলোমিটার’। আগেই বলেছি, কোলা সুপারডিপ বোরহোলের গভীরতা ১২ দশমিক ২৬২ কিলোমিটার।
প্রশ্ন হলো, এত গভীর গর্ত খুঁড়ে বিজ্ঞানীরা কী পেলেন? কী শেখা গেল গর্ত খুঁড়ে? অনেক কিছুই শেখা গেছে। কিছু উদাহরণ দিই। ৬ দশমিক ৯ কিলোমিটার গভীরে একটা এককোষী প্ল্যাঙ্কটন পাওয়া গেছে। আবার এই গভীরতায় পানিও পাওয়া গেছে। মাটির এত গভীরে প্রাণ থাকা আশ্চর্য বটে। গর্তের একদম নিচে তাপমাত্রা ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩৬৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এই তাপমাত্রা বিজ্ঞানীরা আগে যত অনুমান করেছিলেন, তার প্রায় দ্বিগুণ।
১৯৯২ সালে গর্ত খোঁড়া বন্ধ করে দেওয়ার কারণও এটি। আরও গভীরে গর্ত খোঁড়ার ক্ষেত্রে জায়গাটা একটু বেশিই উত্তপ্ত। ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন বছরের পুরোনো পাথর আছে এখানে। অনেক বেশি তাপমাত্রার জন্য পাথরগুলো প্রায় তরল অবস্থায় ছিল। এগুলো যত না পাথরের মতো, তার চেয়ে বেশি প্লাস্টিকের মতো। ফলে গর্তটা সামলানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। গর্ত খোঁড়ার যন্ত্রপাতিগুলো তাপের জন্য দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। ভূতাত্ত্বিক অ্যান্ড্রুসের ভাষ্যমতে, তাপমাত্রা যন্ত্রপাতি গলিয়ে ফেলে। যত গভীরে যাওয়া হয়, ভূমির গঠন তত তরল হয়। তাপমাত্রা তত বাড়ে। তাই পুরো ব্যাপারটা আরও কঠিন হয়ে যায়। গরম স্যুপের বাটির মাঝখানে গর্ত ধরে রাখার মতো অবস্থা।’
আবার ভূপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দূরত্ব আরও ভালোভাবে পরিমাপের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা এই গর্ত থেকে সুবিধা পেয়েছেন। কেন্দ্রের দূরত্ব পাওয়া গেছে ৪ হাজার মাইল বা ৬ হাজার ৩৪৭ কিলোমিটার। ভূত্বকের অনেকটা জুড়ে থাকলেও গর্তটা কেন্দ্র-দূরত্বের তুলনায় বালতিতে একটা ছিদ্রের মতো। ভূত্বক ভূপৃষ্ঠের নিচে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার। ভূত্বকের নিচের স্তর ভূ-ম্যান্টল বা ম্যান্টল প্রায় ২ হাজার ৮৯৬ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত পুরু। বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য ছিল এই ম্যান্টল পর্যন্ত পৌঁছানো।
কিছু তেল-গ্যাস কোম্পানি ভূপৃষ্ঠে এবং সমুদ্রতলে আরও গভীর গর্ত খোঁড়ার দাবি করেছে। ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানি লিমিটেড (বিপি’) ডিপ ওয়াটার হরাইজন সমুদ্রতলে প্রায় ৩০ হাজার ফুট বা ৫ মাইল গভীরে যাওয়ার দাবি করে। যেটা ২০১০ সালে এক দুর্ঘটনায়, বিস্ফোরণে বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৮ সালে কাতারের আল শাহীন তেলখনির গভীরতা পরিমাপ করে দেখা যায় ১২ দশমিক ২৮৯ কিলোমিটার। ২০১১ সালে রাশিয়ার শাখালিন দ্বীপের উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গর্তের তলদেশ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য পরিমাপ করা হয় ১২ দশমিক ৩৪৫ কিলোমিটার। তাই এখন পর্যন্ত মানুষের খোঁড়া গভীরতম গর্তের নাম এটাই-কোলা সুপারডিপ বোরহোল।
বর্তমানে জাপানিরা চেষ্টা করছে পৃথিবীর আরও গভীরে যাওয়ার। জাপানি বিশেষায়িত জাহাজ দ্য শিকুর মাধ্যমে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। জাহাজটি সমুদ্রের তলদেশে খুঁড়তে পারে। একদল আন্তর্জাতিক গবেষক এই প্রকল্পে কাজ করছেন। সমুদ্রতলে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গভীরে খুঁড়তে পেরেছে এই জাহাজ। এটি ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার পর্যন্ত খুঁড়েছে। দ্য শিকুকে ব্যবহার করে খোঁড়াখুঁড়ির এই চেষ্টা শুরু হয়েছে ২০০৩ সালে। এখানেও ম্যান্টল পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ম্যান্টলে তাপমাত্রা শুরু হয় ৮৭১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১৬০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট থেকে। এত তাপমাত্রায় আমাদের জন্য নতুন কী অপেক্ষা করছে, কে জানে? অনেক বছর লাগবে এই প্রকল্প শেষ হতে। আর খরচ হবে প্রায় এক বিলিয়ন ইউএস ডলার!