সংবাদ শিরোনাম ::
শাহজাদপুরে আওয়ামীলীগের সাবেক দুই এমপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা বেলকুচিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ  শাহজাদপুরে অটোবাইক ছিনতাই চক্রের ৬ জন আটক ৭ নভেম্বর না আসলে বাংলাদেশ বিলীন হয়ে যেত: বাউবি উপাচার্য বেলকুচির সেন ভাঙ্গাবাড়ী বাজার মসজিদের নির্মাণ কাজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন “জয় বাংলা” স্লোগান দেওয়ায় সাবেক পিপি-কে গণপিটুনি, পুলিশে সোপর্দ উলিপুরে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ভোট কেন্দ্র মেরামতের টাকা আত্নসাতের অভিযোগ খাজা শাহ্ এনায়েতপুরী (রহ:) এর ১১০ তম ওরছ শরীফের দাওয়াত পত্র বিতরণ  রাজশাহীর মাঠে স্পীড স্কেটিংয়ে বগুড়ার স্কেটারদের ৩টি স্বর্ণপদক সহ ৮ পদক অর্জন এনায়েতপুরে ৭ই নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি উপলক্ষে আলোচনা সভা

গাছের শতায়ুর রহস্য 

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১০:৫০:৩৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ৬১ বার পড়া হয়েছে

বাংলা পোর্টাল: প্রাণিজগতের টিকে থাকার জন্য গাছের বিকল্প নেই। পৃথিবীকে আজও বসবাসের উপযোগী রেখেছে এই গাছেরাই। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।’

উদ্ভিদের প্রাণ আছে-তা প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করেন বাঙালি উদ্ভিদবিদ জগদীশচন্দ্র বসু। তিনি নতুন একধরনের যন্ত্র বানিয়েছিলেন। বলা ভালো, উদ্ভাবন করেছিলেন। কোনো কোনো সূত্র মতে, এ যন্ত্রের নাম এসকোনোগ্রাফ।১ এর সাহায্যে তিনি গাছের জীবন ও কর্মকাণ্ড-যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস, বৃদ্ধি ও উত্তেজনা পরিমাপ করেন বলে জানা যায়। তবে কিছু সূত্র মতে যন্ত্রটির নাম ছিল ক্রেস্কোগ্রাফ।২ এর মাধ্যমে উদ্ভিদের বৃদ্ধির সূক্ষ্ম তারতম্যও পরিমাপ করা যেত। এর মাধ্যমে রেকর্ড করা লেখচিত্রগুলো থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, গাছেরও জীবন আছে।

বৃক্ষ, গুল্ম, বিরুৎ-এই তিন ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে জগতে। পৃথিবীর বৃহত্তম জীবন্ত গাছ ‘জেনারেল শেরম্যান’ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রতম উদ্ভিদ ‘বামন উইলো’-সব এই বিশাল উদ্ভিদ জগতের অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত পোকা আক্রমণ না করলে কোনো বৃক্ষকে মরতে দেখা যায় না।

বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদের আয়ু সাধারণত ৫০০ থেকে ৮০০ বছরের মতো হয়। তবে পৃথিবীতে কিছু কিংবদন্তি গাছ হাজারো বছর ধরে টিকে আছে। সে তুলনায় মানুষের গড় আয়ু মাত্র ৬৮-৭৪ বছরের মতো। মানুষের সর্বোচ্চ বেঁচে থাকার রেকর্ড ১২২ বছর। এটাও আসলে গাছের, বিশেষ করে বৃক্ষের দীর্ঘ জীবনের তুলনায় নগণ্য। প্রশ্ন হলো, কীভাবে একটি বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ এত বছর ধরে বাঁচে’?

বীজ থেকে গাছ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে মাটিতে শেকড় গেঁথে, ডালপালা ছড়িয়ে গাছ ছুঁয়ে ফেলে আকাশ। শতাব্দী ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাতা ঝরে, নতুন পাতা গজায়। কত ঝড়, বন্যা, খরার কবলে পড়ে, তার ঠিক নেই। তবু গাছ টিকে থাকে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকিয়ে রাখে নিজেকে, বাঁচিয়ে রাখে পৃথিবীকে।

গাছের দীর্ঘ জীবনের রহস্য লুকিয়ে আছে তাদের জৈবিক গঠনে। বিষয়টি জানা গেছে একদল বিজ্ঞানীর প্রচেষ্টায়। গাছের হাজারো বছর বেঁচে থাকার রহস্য ভেদ করেছেন তাঁরা। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের একদল বিজ্ঞানী এই গবেষণা করেছেন। এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা (পিএনএএস) জার্নালে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসের জার্নাল এটি। এই বিজ্ঞানীদল গবেষণাপত্রে দাবি করেছেন, তাঁরা গাছের দীর্ঘায়ুর রহস্য ভেদ করেছেন। সে জন্য তাঁরা গবেষণা করেছেন বিশ্বের প্রাগৈতিহাসিক গাছগুলো নিয়ে।

এ বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণা চালান ‘মেইডেনহেয়ার’ নামে পরিচিত ‘গিঙ্কগো বাইলোবা’ গাছে। শরৎকালে মেইডেনহেয়ার গাছের পাতাগুলো আকর্ষণীয় হলুদ বর্ণ ধারণ করে। একেকটি মেইডেনহেয়ার গাছ বেঁচে থাকে এক হাজার বছরের বেশি। এ গাছ তার জীবনজুড়ে এমন কিছু জৈব রাসায়নিক তৈরি করে, যা একে রোগ, পোকামাকড় ও বৈরি পরিবেশ-যেমন খরা মোকাবিলায় সাহায্য করে। এ ছাড়া গাছটির বিশেষ জিনও ভূমিকা রাখে এ ক্ষেত্রে।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএনের লাল তালিকায় রয়েছে এই উদ্ভিদ প্রজাতি। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা প্রাণী ও উদ্ভিদকে এই তালিকাভুক্ত করে আইইউসিএন। এই মেইডেনহেয়ার গাছ গিঙ্কগোলস বর্গের সদস্য। এই বর্গের বাকি প্রজাতিগুলো ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

গিঙ্কগো বাইলোবা প্রজাতির আদিতম যে সদস্যের জীবাশ্মের খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তাও সেই ডাইনোসরদের যুগের

গিঙ্কগো বাইলোবা গাছটির আদিনিবাস চীনে। এখনো দেশটির ঝেজিয়াং এলাকার সিতিয়ানমু পার্বত্য এলাকায় গিঙ্কগো বাইলোবার দেখা পাওয়া যায়। বন উজাড়সহ নানা কারণে বিশ্বের আর কোনো বনে এই গাছ অবশিষ্ট নেই বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের বিভিন্ন জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বাগানে এর কয়েকটির দেখা মেলে।

গিঙ্কগো বাইলোবা প্রজাতির আদিতম যে সদস্যের জীবাশ্মের খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তাও সেই ডাইনোসরদের যুগের। গবেষণাপত্রে বলা হয়, এ গবেষণার সময় গিঙ্কগো বাইলোবা গাছের ১৫ থেকে ৬৬৭ বছর বয়সী কয়েকটি গাছের কোষ, বাকল, পাতা ও বীজ বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

তাঁরা দেখেছেন, তরুণ ও বয়স্ক-সব গাছেই খরা বা জীবাণুর আক্রমণ মোকাবিলায় এদের শরীরে একই ধরনের রাসায়নিক তৈরি হয়। এর মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ও বিশেষ উদ্ভিজ্জ হরমোন উল্লেখযোগ্য। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করে কোষের ক্ষতি রোধ করে। গাছের নিজস্ব অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট তৈরি করার ক্ষমতা থাকে, এবং কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মাটি থেকে শোষণ করে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল পদার্থ গাছের স্বাস্থ্য ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো গাছকে সংক্রমণ, রোগ, পোকামাকড়ের আক্রমণ এবং আঘাত থেকে রক্ষা করে। খরার সময় গাছ অ্যাবসিসিক অ্যাসিড (ABA) নামে একধরনের রাসায়নিক তৈরি করে, যা পানিশূন্যতা কমাতে সাহায্য করে। আর জীবাণুর আক্রমণের সময় গাছ স্যালিসিলিক অ্যাসিড (SA) তৈরি করে। এটি জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে গাছকে।

সারা বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্রিসেলকোন পাইন গাছটির নাম মেথুসেলাহ। ধারণা করা হয়, এ গাছটির বয়স ৪ হাজার ৮০০ বছরেরও বেশি

মানুষের যেমন বার্ধক্যের সময় নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয় শরীরে, উদ্ভিদের ক্ষেত্রে তা হয় না। বরং উল্টোটা ঘটে। এ ধরনের উদ্ভিদের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জৈব রাসায়নিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। গিঙ্কগো বাইলোবা গাছের জিন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বয়স হলেও অন্য গাছের মতো এই গাছে বার্ধক্যজনিত কোনো বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় না। পরিবেশে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে মেইডেনহেয়ারে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। বজ্রপাত বা অন্য কোনো কারণে গাছটির কাণ্ড কিংবা অন্য অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই প্রজাতির গাছ তা পূরণ করতে পারে নিজেই।

পৃথিবীতে মেইডেনহেয়ার বা গিঙ্কগো বাইলোবা ছাড়াও আরও অনেক প্রজাতির হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকা বৃক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো গ্রেট বেসিন ব্রিসেলকোন পাইন। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে এখনও যেসব গাছপালা ও পশুপাখি বেঁচে আছে, তার মধ্যে গ্রেট বেসিন ব্রিসেলকোন পাইন গাছই সবচেয়ে প্রাচীন। সারা বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্রিসেলকোন পাইন গাছটির নাম মেথুসেলাহ। ধারণা করা হয়, এ গাছটির বয়স ৪ হাজার ৮০০ বছরেরও বেশি। অর্থাৎ মিশরীয়রা যখন গ্রেট পিরামিড নির্মাণ করছিল, তখন এটি ছিল চারাগাছ। এর দীর্ঘ জীবনের পেছনে দারুণ একটি বিষয় হচ্ছে, এটি অত্যন্ত বিরূপ ও বৈরী পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। এসব গাছের জন্মও হয় সেরকম পরিবেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাডা এবং ইউটাহর উঁচু উঁচু পর্বতে এ গাছ জন্মায়। জীবন চক্র অত্যন্ত ধীরে অতিক্রম করে এরা।

এগুলো জাপানি সেডার নামেও পরিচিত। হালকা শীতের আবহাওয়ার মধ্যে এই গাছ জন্মায়। জাপানের এরকম কিছু কিছু গাছের বয়স ৬৫০ বছরেরও বেশি বলে ধারণা করা হয়

দীর্ঘায়ু গাছের বেঁচে থাকার পেছনে ভাজক টিস্যু বা মেরিস্টেম্যাটিক কোষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেরিস্টেম্যাটিক কোষ হলো উদ্ভিদের অবিভাজিত কোষ। বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী কোষে রূপান্তরিত হতে পারে এগুলো। উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অন্যান্য দীর্ঘায়ু গাছের মধ্যে রয়েছে ক্রিপ্টোমেরিয়া। এগুলো জাপানি সেডার নামেও পরিচিত। হালকা শীতের আবহাওয়ার মধ্যে এই গাছ জন্মায়। জাপানের এরকম কিছু কিছু গাছের বয়স ৬৫০ বছরেরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। এ ছাড়াও চিলি ও আর্জেন্টিনার দক্ষিণাঞ্চলে আলেরসা নামে একধরনের গাছ আছে। এগুলো প্যাটাগোনিয়ান সাইপ্রেস নামেও পরিচিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গাছটিতে এমন একধরনের রস আছে, যা তাদের পচনের হাত থেকে রক্ষা করে। এমনকি পানিতে থাকলেও এই গাছ পচে না।

আফ্রিকান বেওবাব বৃক্ষ ২ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি এই প্রজাতির অনেক প্রাচীন গাছ মারা গেছে। বিজ্ঞানীরা এর জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করছেন। এই গাছটি নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি এমন ফল দেয়, যাতে কমলার চেয়েও বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এর শেকড় থেকে লাল রং তৈরি করা যায় এবং এর বাকল দিয়ে ঝুড়ি ও দড়ির মতো নানা রকম জিনিস তৈরি করা যায়।

গাছ চরম পরিস্থিতিও সহ্য করতে পারে। যেমন বৃক্ষের মূলগুলো মাটিতে শক্তভাবে গেঁথে থাকে এবং শরীরের ওজন বহন করে। কাণ্ড ও ডালপালা শক্তিশালী ও নমনীয় হয়। ফলে গাছ ঝড়-বৃষ্টির মতো আবহাওয়ার চরম অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। তা ছাড়া গাছের কোষ দীর্ঘজীবী। এটি গাছকে ক্ষতি থেকে সারিয়ে তোলে। বৃক্ষের বাকল দীর্ঘজীবী কোষ দ্বারা গঠিত হয়, যা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পুনরায় বৃদ্ধি পায়। এসব কারণও গাছকে দীর্ঘায়ু হতে সাহায্য করে। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানব সৃষ্ট নানা কারণে প্রাগৈতিহাসিক এসব গাছও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের সবার সচেতন হতে হবে। তবেই ভালো থাকবে পৃথিবী।’

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

গাছের শতায়ুর রহস্য 

আপডেট সময় : ১০:৫০:৩৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

বাংলা পোর্টাল: প্রাণিজগতের টিকে থাকার জন্য গাছের বিকল্প নেই। পৃথিবীকে আজও বসবাসের উপযোগী রেখেছে এই গাছেরাই। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।’

উদ্ভিদের প্রাণ আছে-তা প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করেন বাঙালি উদ্ভিদবিদ জগদীশচন্দ্র বসু। তিনি নতুন একধরনের যন্ত্র বানিয়েছিলেন। বলা ভালো, উদ্ভাবন করেছিলেন। কোনো কোনো সূত্র মতে, এ যন্ত্রের নাম এসকোনোগ্রাফ।১ এর সাহায্যে তিনি গাছের জীবন ও কর্মকাণ্ড-যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস, বৃদ্ধি ও উত্তেজনা পরিমাপ করেন বলে জানা যায়। তবে কিছু সূত্র মতে যন্ত্রটির নাম ছিল ক্রেস্কোগ্রাফ।২ এর মাধ্যমে উদ্ভিদের বৃদ্ধির সূক্ষ্ম তারতম্যও পরিমাপ করা যেত। এর মাধ্যমে রেকর্ড করা লেখচিত্রগুলো থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, গাছেরও জীবন আছে।

বৃক্ষ, গুল্ম, বিরুৎ-এই তিন ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে জগতে। পৃথিবীর বৃহত্তম জীবন্ত গাছ ‘জেনারেল শেরম্যান’ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রতম উদ্ভিদ ‘বামন উইলো’-সব এই বিশাল উদ্ভিদ জগতের অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত পোকা আক্রমণ না করলে কোনো বৃক্ষকে মরতে দেখা যায় না।

বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদের আয়ু সাধারণত ৫০০ থেকে ৮০০ বছরের মতো হয়। তবে পৃথিবীতে কিছু কিংবদন্তি গাছ হাজারো বছর ধরে টিকে আছে। সে তুলনায় মানুষের গড় আয়ু মাত্র ৬৮-৭৪ বছরের মতো। মানুষের সর্বোচ্চ বেঁচে থাকার রেকর্ড ১২২ বছর। এটাও আসলে গাছের, বিশেষ করে বৃক্ষের দীর্ঘ জীবনের তুলনায় নগণ্য। প্রশ্ন হলো, কীভাবে একটি বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ এত বছর ধরে বাঁচে’?

বীজ থেকে গাছ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে মাটিতে শেকড় গেঁথে, ডালপালা ছড়িয়ে গাছ ছুঁয়ে ফেলে আকাশ। শতাব্দী ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাতা ঝরে, নতুন পাতা গজায়। কত ঝড়, বন্যা, খরার কবলে পড়ে, তার ঠিক নেই। তবু গাছ টিকে থাকে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকিয়ে রাখে নিজেকে, বাঁচিয়ে রাখে পৃথিবীকে।

গাছের দীর্ঘ জীবনের রহস্য লুকিয়ে আছে তাদের জৈবিক গঠনে। বিষয়টি জানা গেছে একদল বিজ্ঞানীর প্রচেষ্টায়। গাছের হাজারো বছর বেঁচে থাকার রহস্য ভেদ করেছেন তাঁরা। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের একদল বিজ্ঞানী এই গবেষণা করেছেন। এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা (পিএনএএস) জার্নালে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসের জার্নাল এটি। এই বিজ্ঞানীদল গবেষণাপত্রে দাবি করেছেন, তাঁরা গাছের দীর্ঘায়ুর রহস্য ভেদ করেছেন। সে জন্য তাঁরা গবেষণা করেছেন বিশ্বের প্রাগৈতিহাসিক গাছগুলো নিয়ে।

এ বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণা চালান ‘মেইডেনহেয়ার’ নামে পরিচিত ‘গিঙ্কগো বাইলোবা’ গাছে। শরৎকালে মেইডেনহেয়ার গাছের পাতাগুলো আকর্ষণীয় হলুদ বর্ণ ধারণ করে। একেকটি মেইডেনহেয়ার গাছ বেঁচে থাকে এক হাজার বছরের বেশি। এ গাছ তার জীবনজুড়ে এমন কিছু জৈব রাসায়নিক তৈরি করে, যা একে রোগ, পোকামাকড় ও বৈরি পরিবেশ-যেমন খরা মোকাবিলায় সাহায্য করে। এ ছাড়া গাছটির বিশেষ জিনও ভূমিকা রাখে এ ক্ষেত্রে।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএনের লাল তালিকায় রয়েছে এই উদ্ভিদ প্রজাতি। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা প্রাণী ও উদ্ভিদকে এই তালিকাভুক্ত করে আইইউসিএন। এই মেইডেনহেয়ার গাছ গিঙ্কগোলস বর্গের সদস্য। এই বর্গের বাকি প্রজাতিগুলো ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

গিঙ্কগো বাইলোবা প্রজাতির আদিতম যে সদস্যের জীবাশ্মের খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তাও সেই ডাইনোসরদের যুগের

গিঙ্কগো বাইলোবা গাছটির আদিনিবাস চীনে। এখনো দেশটির ঝেজিয়াং এলাকার সিতিয়ানমু পার্বত্য এলাকায় গিঙ্কগো বাইলোবার দেখা পাওয়া যায়। বন উজাড়সহ নানা কারণে বিশ্বের আর কোনো বনে এই গাছ অবশিষ্ট নেই বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের বিভিন্ন জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বাগানে এর কয়েকটির দেখা মেলে।

গিঙ্কগো বাইলোবা প্রজাতির আদিতম যে সদস্যের জীবাশ্মের খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তাও সেই ডাইনোসরদের যুগের। গবেষণাপত্রে বলা হয়, এ গবেষণার সময় গিঙ্কগো বাইলোবা গাছের ১৫ থেকে ৬৬৭ বছর বয়সী কয়েকটি গাছের কোষ, বাকল, পাতা ও বীজ বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

তাঁরা দেখেছেন, তরুণ ও বয়স্ক-সব গাছেই খরা বা জীবাণুর আক্রমণ মোকাবিলায় এদের শরীরে একই ধরনের রাসায়নিক তৈরি হয়। এর মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ও বিশেষ উদ্ভিজ্জ হরমোন উল্লেখযোগ্য। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করে কোষের ক্ষতি রোধ করে। গাছের নিজস্ব অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট তৈরি করার ক্ষমতা থাকে, এবং কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মাটি থেকে শোষণ করে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল পদার্থ গাছের স্বাস্থ্য ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো গাছকে সংক্রমণ, রোগ, পোকামাকড়ের আক্রমণ এবং আঘাত থেকে রক্ষা করে। খরার সময় গাছ অ্যাবসিসিক অ্যাসিড (ABA) নামে একধরনের রাসায়নিক তৈরি করে, যা পানিশূন্যতা কমাতে সাহায্য করে। আর জীবাণুর আক্রমণের সময় গাছ স্যালিসিলিক অ্যাসিড (SA) তৈরি করে। এটি জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে গাছকে।

সারা বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্রিসেলকোন পাইন গাছটির নাম মেথুসেলাহ। ধারণা করা হয়, এ গাছটির বয়স ৪ হাজার ৮০০ বছরেরও বেশি

মানুষের যেমন বার্ধক্যের সময় নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয় শরীরে, উদ্ভিদের ক্ষেত্রে তা হয় না। বরং উল্টোটা ঘটে। এ ধরনের উদ্ভিদের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জৈব রাসায়নিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। গিঙ্কগো বাইলোবা গাছের জিন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বয়স হলেও অন্য গাছের মতো এই গাছে বার্ধক্যজনিত কোনো বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় না। পরিবেশে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে মেইডেনহেয়ারে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। বজ্রপাত বা অন্য কোনো কারণে গাছটির কাণ্ড কিংবা অন্য অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই প্রজাতির গাছ তা পূরণ করতে পারে নিজেই।

পৃথিবীতে মেইডেনহেয়ার বা গিঙ্কগো বাইলোবা ছাড়াও আরও অনেক প্রজাতির হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকা বৃক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো গ্রেট বেসিন ব্রিসেলকোন পাইন। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে এখনও যেসব গাছপালা ও পশুপাখি বেঁচে আছে, তার মধ্যে গ্রেট বেসিন ব্রিসেলকোন পাইন গাছই সবচেয়ে প্রাচীন। সারা বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্রিসেলকোন পাইন গাছটির নাম মেথুসেলাহ। ধারণা করা হয়, এ গাছটির বয়স ৪ হাজার ৮০০ বছরেরও বেশি। অর্থাৎ মিশরীয়রা যখন গ্রেট পিরামিড নির্মাণ করছিল, তখন এটি ছিল চারাগাছ। এর দীর্ঘ জীবনের পেছনে দারুণ একটি বিষয় হচ্ছে, এটি অত্যন্ত বিরূপ ও বৈরী পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। এসব গাছের জন্মও হয় সেরকম পরিবেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাডা এবং ইউটাহর উঁচু উঁচু পর্বতে এ গাছ জন্মায়। জীবন চক্র অত্যন্ত ধীরে অতিক্রম করে এরা।

এগুলো জাপানি সেডার নামেও পরিচিত। হালকা শীতের আবহাওয়ার মধ্যে এই গাছ জন্মায়। জাপানের এরকম কিছু কিছু গাছের বয়স ৬৫০ বছরেরও বেশি বলে ধারণা করা হয়

দীর্ঘায়ু গাছের বেঁচে থাকার পেছনে ভাজক টিস্যু বা মেরিস্টেম্যাটিক কোষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেরিস্টেম্যাটিক কোষ হলো উদ্ভিদের অবিভাজিত কোষ। বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী কোষে রূপান্তরিত হতে পারে এগুলো। উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অন্যান্য দীর্ঘায়ু গাছের মধ্যে রয়েছে ক্রিপ্টোমেরিয়া। এগুলো জাপানি সেডার নামেও পরিচিত। হালকা শীতের আবহাওয়ার মধ্যে এই গাছ জন্মায়। জাপানের এরকম কিছু কিছু গাছের বয়স ৬৫০ বছরেরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। এ ছাড়াও চিলি ও আর্জেন্টিনার দক্ষিণাঞ্চলে আলেরসা নামে একধরনের গাছ আছে। এগুলো প্যাটাগোনিয়ান সাইপ্রেস নামেও পরিচিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গাছটিতে এমন একধরনের রস আছে, যা তাদের পচনের হাত থেকে রক্ষা করে। এমনকি পানিতে থাকলেও এই গাছ পচে না।

আফ্রিকান বেওবাব বৃক্ষ ২ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি এই প্রজাতির অনেক প্রাচীন গাছ মারা গেছে। বিজ্ঞানীরা এর জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করছেন। এই গাছটি নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি এমন ফল দেয়, যাতে কমলার চেয়েও বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এর শেকড় থেকে লাল রং তৈরি করা যায় এবং এর বাকল দিয়ে ঝুড়ি ও দড়ির মতো নানা রকম জিনিস তৈরি করা যায়।

গাছ চরম পরিস্থিতিও সহ্য করতে পারে। যেমন বৃক্ষের মূলগুলো মাটিতে শক্তভাবে গেঁথে থাকে এবং শরীরের ওজন বহন করে। কাণ্ড ও ডালপালা শক্তিশালী ও নমনীয় হয়। ফলে গাছ ঝড়-বৃষ্টির মতো আবহাওয়ার চরম অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। তা ছাড়া গাছের কোষ দীর্ঘজীবী। এটি গাছকে ক্ষতি থেকে সারিয়ে তোলে। বৃক্ষের বাকল দীর্ঘজীবী কোষ দ্বারা গঠিত হয়, যা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পুনরায় বৃদ্ধি পায়। এসব কারণও গাছকে দীর্ঘায়ু হতে সাহায্য করে। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানব সৃষ্ট নানা কারণে প্রাগৈতিহাসিক এসব গাছও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের সবার সচেতন হতে হবে। তবেই ভালো থাকবে পৃথিবী।’